র্যাট কিলার
-শিলাবৃষ্টি
গণেশ আর গণেশের বউ টুম্পার খুব কষ্টে দিন চলে। রোজগার পাতি খুব কমে গেছে। এখন আর ইঁদুর মারা বিষ তেমন বিক্রি হয়না শহর বাজারে, ট্রেনে বাসে। টুম্পা গণেশকে বোঝায় এভাবে আর কদিন চলবে! সে একটা বাসন মাজার কাজ পেয়েছে। গণেশ মত দিলেই সে দু বেলা লোকের বাড়িতে খেটে কিছু টাকা রোজগার করতে পারে! কিন্তু গণেশ একদম রাজি হয়না। সে বলে ” দেখ টুম্পা! আমাদের একটা বংশ মর্যাদা ছিল! আজ হয়তো নুন আনতে পান্তা ফুরোয় কিন্তু আমার ঠাকুরদাদা বড় পূজারী ছিল। আমরা ব্রাহ্মণ! তুই কিনা লোকেদের বাড়িতে এঁটো বাসন মাজবি? ” টুম্পা এসব কথা বহুবার শুনেছে! গণেশ রেগে গেলে সে চুপ করে যায়! কিন্তু কিছু তো একটা করতেই হবে!
কয়েকদিন পরেই টুম্পা বুঝতে পারে তার পেটে গণেশের সন্তান। তাদের ভালোবাসার সম্পদ। কিন্তু এই অভাব অনটনের মধ্যে সেই সন্তানকে কিভাবে সে পৃথিবীর আলো দেখাবে!কয়েকদিন ধরেই গণেশের জ্বর আসছিল, সে ফেরি করতে বেরোতে পারেনি। টুম্পা দোকানে ধার করে চাল ডাল, আর ওষুধ কিনে চালাচ্ছিল। না আর গণেশের কথা শুনলে হবেনা। তাকে কাজটা ধরতেই হবে।
গণেশকে আজ সকালে হাসপাতালে টিকিট করে দেখাতে নিয়ে গেছিল। ডাক্তারবাবু কেন জানি ভর্তি করে দিতে বললো। টুম্পা চিন্তায় পড়লেও ভর্তি করেই ফিরলো। তবে ডাক্তারবাবু বলেছে ভয় নেই কোনো। শরীর দুর্বল, তাই সেলাইন দিতে হবে।
আর দেরি না করে সে ছুটলো কাজের বাড়িতে। বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে, কাজটা যদি অন্য কেউ ধরে নেয়!
যা ভেবেছে ঠিক তাই। ও বাড়ির মাসীমা বললেন ” নারে বৌ, তুই পরের দিন এলিনা দেখে অন্য লোক লাগিয়েছি।”
টুম্পা অসহায় ভাবে মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসতে যাবে, এমন সময় মাসীমা ডাকে
” এই শোন শোন, তুই ভালো রান্না করতে পারিস? ” টুম্পা হাতে যেন স্বর্গ পেল। ” হ্যাঁ মাসীমা আমি খুব ভালো রান্না পারি।”
“তোরা কি জাত?”
” আমরা চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ গো মাসীমা, অবস্থার ফেরে আজ কাজ খুঁজে ফিরছি।”
মাসীমা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ” তাহলে
কাল থেকেই লেগে পড়। আমাদের বোউটা পোয়াতি। সে আর নিজে রান্না করে খেতেই পারছেনা। খুব অরুচি মুখে! ” টুম্পা অন্যমনস্ক হয়ে যায়… সেওতো পোয়াতি, অথচ…. যাক গে”
রাতে একা ঘরে শুয়ে শুয়ে টুম্পা ভাবে এখন কোনো কথা গণেশকে সে জানাবেনা। টুম্পা যে মা হতে চলেছে তাও সে গণেশকে লুকিয়ে রেখেছে। রান্নার কাজে বেশী অসম্মান নেই, পরে গণেশ জানলে খুশিই হবে হয়তো।
সকাল হতে না হতেই টুম্পা রান্না করতে বেরিয়ে গেল। ভালোই লাগছে তার অনেক রকম রান্না করতে। জল খাবারের পরোটা আলুর দম তাকেও খেতে দিল মাসীমা। ওরা বলেছে টুম্পা রান্না খারাপ করেনা। দু’হাজার টাকা দেবে ওরা। মাসীমা অগ্রিম টাকা দিয়েছেন কিছু, তাতেই চালাতে হবে।
দশটার সময় সে গণেশের কাছে গেল। আজ গণেশকে অনেকটা সুস্থ লাগছে। টুম্পার মনটা শান্ত হলো। চার বছর ওদের বিয়ে হয়েছে। দুজনেই দুজনকে খুব ভালোবাসে। গণেশ সব সময় টুম্পাকে আগলিয়ে রাখতে চায়। ডাক্তার বাবু বলেছে কাল ছুটি দেবে।
পরের দিন কাজের বাড়ি থেকে এসে
টুম্পা গণেশকে বাড়িতে নিয়ে এলো। মাছের ঝোল ভাত রান্না করে দুজনে খেল।
গণেশ প্রশ্ন করে ” তুই বাজার করেছিস, মাছ এনেছিস কিন্তু টাকা কোথায় পেলি?”
টুম্পা বলে ‘ তুমি এখন অসুস্থ, এত কথা তোমাকে চিন্তা করতে হবেনা! ” গণেশ বিকেলের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছে। আসলে ওষুধ খেয়ে শুধুই ওর ঘুম ঘুম পাচ্ছে।
সন্ধ্যা বেলায় রুটি বানাতে যেতে হবে মাসীমাদের বাড়িতে, টুম্পা একবার ভাবলো গণেশকে বলেই যাবে। কিন্তু ও তো ঘুমাচ্ছে। থাক রাতেই সে সব খুলে বলবে। ভালো তাঁতের শাড়িটা পরে সে বেরিয়ে যায় সন্তর্পণে।
পাশের বাড়ির কাকি এসে ডাকে ” ও গণেশ ওঠ বাবা, ওঠ। আজ কেমন আছিস? তোকে দেখতে এলাম!” গণেশ উঠে বসে। টুম্পাকে ডাকে। কাকি বলে ” তোর বৌ তো কাজ ধরেছে ওই রায় বাড়িতে। সেখানেই গেছে বোধহয়!” গণেশ
আকাশ থেকে পড়ে, সে স্তম্ভিত। টুম্পা তার অমতে রায় বাড়িতে বাসন মাজতে গেছে! সে থ হয়ে বসে থাকে। কাকি চলে গেলে রাগে দুঃখে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে ঘরের তাকে থরে থরে সাজিয়ে
রাখা তার ব্যবসার জন্য কেনা ইঁদুর মারা বিষ কয়েকপাতা জলে গুলে খেয়ে নেয়। এ জীবন থেকে কি হবে! স্বামী হয়ে স্ত্রীকে খেতে দিতে পারেনা সে। তাই তো টুম্পা বাসন মেজে খাওয়ার জোগাড় করে। তাদের বংশের সম্মান আজ ধুলোয় মিশে গেল। সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। গণেশের
জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে। ” টু..ম্পা, টু…ম্পা” কেমন যেন একটা গোঙানির মতো আওয়াজ বেরোচ্ছে গণেশের গলা থেকে।
টুম্পা খানিক বাদেই এসে পড়ে। দরজা ঠেলে ঢুকে আলোটা জ্বালিয়ে সে হতবাক। একি! গণেশ এরকম ভাবে শুয়ে আছে কেন? মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে কেন? মেঝের দিকে তাকিয়ে সে চিৎকার করে ওঠে ” গ…ণে…শ”। বিষের ছেঁড়া প্যাকেটগুলো ছড়িয়ে পড়ে আছে এদিক ওদিক।
ছুটে বাইরে বেরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পাড়ার ছেলেদের ডেকে নিয়ে আসে সে। তারপর সবাই মিলে ধরে একটা ভ্যানে করে হাসপাতালে নিয়ে যায় গণেশকে। ওয়াশ করে প্রায় চার ঘণ্টা পরে গণেশকে ছাড়লো হাসপাতাল থেকে। টুম্পা পাগলের মতো অস্থির হয়ে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়িয়েছে। ঠাকুর তার ডাক শুনেছেন। গণেশ ঘরে এসেছে। তার জ্ঞান ফিরেছে।
রাতে টুম্পা গণেশের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে ” কেন তুমি এরকম কাজ করলে? কিছু যদি হয়ে যেত আমি কোথায় যেতাম? বলো আমার কি হতো?”
কান্নায় ভেঙে পড়ে টুম্পা। গণেশ অভিমানে প্রথমে চুপ করে থাকলেও টুম্পার কান্না তার সহ্য হয়না। বলে – ” তুই
আমার সম্মান নষ্ট করেছিস, আমার অবাধ্য হয়ে কায়েত বাড়িতে এঁটোকাঁটা…. ছি ছি ছি! “
‘ চুপ করো তুমি! আমি রান্নার কাজ নিয়েছি। মাস গেলে দুহাজার টাকা পাবো। আর টাকাটা এখন আমাদের ভীষণ দরকার! “
গণেশ অবাক হয়ে তাকায় টুম্পার মুখের দিকে। সে ভুল ভেবেছিল? বলে – ” কেন টাকা ভীষণ দরকার কেন? “
“টুম্পা চুপ করে থাকে, তারপর গণেশের
পাশে শুয়ে পড়ে গণেশের চোখে চোখ রেখে বলে ” দেখোতো আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে, কিছু বুঝতে পারো কিনা! ” গণেশ খুব ভালো করে টুম্পাকে নিরিক্ষণ করে! ” কি হয়েছে তোর? কোনো অসুখ করেছে? বলনা!”
টুম্পা খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে ” এই যে আমার হাঁদা গঙ্গারাম বর! আরে তোমার টুম্পা যে মা হবে তুমি বুঝতেও পারলেনা? “
” কি!! তুই মা? মানে আমি বাবা হবো?”
পাগলের মতো টুম্পাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে গণেশ। ” ছাড়ো না ” টুম্পা কোনরকমে বলে। গণেশ বলে ” না, ছাড়বোনা আমি তোকে, সারারাত আদর
করবো।”
……………
কত রাত কে জানে। দুজনের বিনিদ্র কাটে। কত কল্পনা দুজনের আগামীর জন্য। টুম্পা বলে – কোনো কাজই ছোট নয় গো! রান্না একটা শিল্প! পরে আমি হোম ডেলিভারি খুলতে পারবো। আমি ভালো ভালো রান্না করবো আর তুমি সাইকেলে করে সেই রান্না অর্ডার মতো বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেবে। আমাদের সন্তানকে আমরা ভালোভাবে মানুষ করবো। “
” হ্যাঁ রে টুম্পা আমি পরশু থেকে আবার ট্রেনে হকারি শুরু করবো। তবে এই সাধারণ ইঁদুর মারা বিষ নয় এবার আমি বিক্রি করবো র্যাট কিলার! “